ঢাকা,মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৪

মিয়ানমারের চামিলা গ্রাম বাংলাদেশিদের ‘বন্দিশালা’

নানা প্রক্রিয়ায় বন্দিশালা থেকে ৭ জনকে উদ্ধার, গ্রেফতার ৪
সুজাউদ্দিন রুবেল, কক্সবাজার ::

সেন্টমার্টিনের পূর্ব-দক্ষিণে মিয়ানমার উপকূলে একটি গ্রাম চামিলা। এই গ্রামে দেড় শতাধিক ঘর করে বসবাস করে মগ ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষ। এই গ্রামের প্রতিটি ঘর যেন বন্দিশালা। যেখানে জিম্মি রয়েছে কয়েকশ বাংলাদেশি। যাদেরকে নানা প্রলোভনের মালয়েশিয়ায় পাচার এবং অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওই বন্দিশালায়। যার মধ্যে তিন বছর ধরে বন্দি বাংলাদেশিও রয়েছে।

সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে পুলিশের তৎপরতায় ফেরত আনার পর উদ্ধার হওয়া ৭ কিশোর ও যুবক এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে।
এরআগে গত রবিবার রাতে মিয়ানমার থেকে সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা এই সাতজনকে টেকনাফের মিঠাপানির ছড়া সংলগ্ন সৈকতে নামিয়ে দেয়। যেখান থেকে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে। এ ঘটনায় সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের নারীসহ ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ।

কক্সবাজার সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
গ্রেপ্তার মানবপাচার চক্রের মূলহোতা টেকনাফ সদর ইউনিয়নের লেঙ্গুর বিল এলাকার মো. বেলাল উদ্দিন এবং তার সহযোগী সাবরাং ইউনিয়নের লাফার ঘোনার মাহফুজা, একই ইউনিয়নের গোলারপাড়া এলাকার আব্দুল্লাহ ও মিয়ানমারের বুচিডং এলাকার আয়াছ।
উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন চকরিয়ার হারবাং ইউনিয়নের স্টেশন পাড়ার রায়হান উদ্দিন, কক্সবাজার পৌরসভার বৈদ্যঘোনা এলাকার মো. রায়হান কবির, একই এলাকার মো. আলমগীর, মহেশখালীর শাপলাপুর ইউনিয়নের সফর আলী, একই এলাকার শওকত আজিজ, উখিয়ার থাইংখালী এলাকার মো. মামুন মিয়া ও সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের মো. হাবিব উল্লাহ।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজার সদর থানায় হওয়া দুটি সাধারণ ডায়েরির (জিডি) তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয় যে একটি সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী চক্র কক্সবাজার সদর, চকরিয়া, মহেশখালী, উখিয়া ও সিরাজগঞ্জের কিছু কিশোর ও যুবককে উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে মালেয়শিয়া পাঠানোর কথা বলে জিম্মি করে। তাদের প্রথমে টেকনাফের লেঙ্গুর বিল এলাকায় নিয়ে যায়। এরপর সাগর পথে মিয়ানমারের একটি আস্তানায় নিয়ে জিম্মি করে। সেখানে জিম্মি করার পর নির্যাতন চালিয়ে ফোনে স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা দাবি করা হয়।

মিজানুর রহমান বলেন, স্বজনরা নির্যাতনের খবর পেয়ে নানাভাবে পাচারকারীদের বিভিন্ন অঙ্কের টাকাও পাঠায়। এই টাকা গ্রহণকারী লোকজন এবং তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশ পাচারকারী চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। এরপর গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কৌশলে ব্যবহার করে রবিবার রাতে মিয়ানমার থেকে টেকনাফের সৈকত এলাকায় ৭ জনকে ফেরত আনা হয়।

‘উদ্ধার হওয়া ব্যক্তি ও গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে আরও নানা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব তদন্ত করে পাচারকারী চক্রের অন্য সদস্যদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার ও নিখোঁজ অন্যদের বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় কক্সবাজার সদর থানা ছাড়াও পৃথকভাবে উখিয়া, টেকনাফ, মহেশখালী ও চকরিয়া থানায় মামলা হয়েছে বলেও জানায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান।
উদ্ধার হওয়া ব্যক্তি ও তাদের স্বজনরা যা জানিয়েছে

কক্সবাজার সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ঘুরে-ঘুরে কয়েক বছর ধরে আনার বিক্রি করেন সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুরের মো. হোসেন আলীর ছেলে মো. হাবিব উল্লাহ। গত ৪ সেপ্টেম্বর সৈকতে এক যুবক তাকে বলে, টেকনাফে এক-একটি আনার পাঁচ টাকায় পাওয়া যায়। যেখানে আনারের বিশাল বাগান রয়েছে। পাঁচ টাকায় ফল কিনে বিক্রি করে অধিক মুনাফা পাওয়া আশার টেকনাফে আনার কিনতে যান হাবিব উল্লাহ। টেকনাফের লেঙ্গুর বিল এলাকার একটি ঘরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই তাকে বেঁধে রাখা হয়।

হাবিব উল্লাহ জানান, ওই ঘরে টানা ছয় দিন তাকে বন্দি করে রাখা হয়। এরপর রাতে হাত-পা বেঁধে একটি ট্রলারে তুলে দেওয়া হয়। ট্রলারটিতে তিনিসহ মোট ৩৮ জন ছিলেন। ট্রলারে করে তাদের মিয়ানমারের উপকূলীয় একটি গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রামে পৌঁছানোর পর তাদের আলাদা আলাদা ঘরে নিয়ে বেঁধে রাখা হয়। মারধর ছাড়াও হত্যার হুমকি দেয়। দাবি করা হয় বিভিন্ন অঙ্কের টাকা।
হাবিব উল্লাহ জানান, তাকে যে ঘরে বন্দি করা হয়েছিল সেখানে আরও ৭/৮ জন রয়েছে।

উদ্ধার হওয়া চকরিয়ার রায়হান উদ্দিন জানান, সৈকতে ব্যবসা করেন তিনি। সেখানে পান বিক্রেতা আরিফ নামের এক যুবকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। আরিফ টেকনাফে ব্যবসা ভালো বলে তাকে নিয়ে যায়। টেকনাফের পর্যটন এলাকায় পৌঁছানোর পর পরই অজ্ঞাত লোকজন তাকে জিম্মি করে একটি ঘরে নিয়ে যায়। ওই ঘরে আরও লোকজন বেঁধে রাখা ছিল। ছয় দিন পর তাদের ট্রলারে তুলে দেওয়া হয়। সেই থেকে তাকে মিয়ানমারের চামিলা গ্রামের একটি ঘরে বন্দি রাখা হয়। তার পরিবারের লোকজন বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর পর আবারও ট্রলারে করে তাকেসহ ৭ জনকে টেকনাফে ফেরত পাঠানো হয়।

উখিয়ার থাইংখালী এলাকার মামুন মিয়া বলেন, তিনি রাজমিন্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন। কাজের সূত্রে টেকনাফে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার পর সৈকত এলাকা থেকে অজ্ঞাত লোকজন তাকে জিম্মি করে একটি ঘরে বেঁধে রাখে। দুদিন পর একটি ট্রলারে তুলে দেওয়া হয়। ট্রলারটিতে ৩৩ জন মানুষ ছিল। সমুদ্রে একের পর এক চারটি ট্রলার পরিবর্তন করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় চামিলা গ্রামে।
মামুন জানান, গ্রামটিতে দেড় শতাধিক ঘর রয়েছে। সেখানে কিছু পরিবার মগ, কিছু পরিবার রোহিঙ্গা। প্রতিটি ঘরে কয়েকজন করে বাংলাদেশি যুবককে বেঁধে রাখা হয়েছে, যাদের একই কায়দায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার পরিবারের সদস্যরা টাকা পাঠানোর পর তাকে রবিবার রাতে ফেরত পাঠানো হয়।

ওই সময় কক্সবাজার সদর থানা প্রাঙ্গনে ছিলেন মামুন মিয়ার মা ছেনোয়ারা বেগমও। তিনি বলেন, তার সন্তান জিম্মি করার পর একমাত্র সম্পদ ইজিবাইক বিক্রি করে পাওয়া টাকা ও ধার করে মোট এক লাখ টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। এরপরই ছেলেকে ফেরত পেয়েছেন।

চকরিয়ার রায়হানের বাবা আবদুর রহমান বলেন, ছেলেকে জিম্মি করার পর নির্যাতন চালানো হয়। এরপর মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠানো ১ লাখ ২০ হাজার টাকা হয়। এরপর পুলিশের নানা তৎপরতায় ছেলেকে ফেরত পেয়েছেন।
কক্সবাজার সদর থানা-পুলিশের তথ্যমতে, নিখোঁজ ৭ জনের মধ্যে কক্সবাজার সদর থানায় রায়হান ও হাবিবের ঘটনায় জিডি হয়েছিল। সেই জিডির সূত্র ধরেই সাতজনকে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। যার মধ্যে চারজনের পরিবার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সাড়ে তিন লাখ টাকা পাঠিয়েছে। রায়হানের পরিবার ১ লাখ ২০ হাজার, সফর আলীর পরিবার ৭৫ হাজার টাকা, শওকতের পরিবার ৭৫ হাজার ও মামুন মিয়ার পরিবার ৭০ হাজার টাকা পাঠিয়েছে।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিষয়ে যা জানিয়েছে পুলিশ
সাগর পথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রলোভনসহ নানা কৌশলে মিয়ানমারে পাচার করে জিম্মি করে এমন একটি চক্রের অন্যতম হোতা গ্রেপ্তার বেলাল উদ্দিন। উদ্ধার হওয়ারা যে ঘরটিতে জিম্মি করার কথা বলেছেন, সেটি লেঙ্গুর বিল এলাকায় বেলালের নিয়ন্ত্রিত। কাউকে জিম্মি করে সেখানে নিয়ে গিয়ে প্রথমে রাখা হয়।
কক্সবাজার সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, বেলাল নিয়ন্ত্রিত ঘরটি গুদাম ঘর হিসেবে পরিচিত। তার অধিনের চক্রটি মূলত মানুষজনকে জিম্মি করে ট্রলারে তুলে দেয়। মিয়ানমারে পৌঁছার পর শুরু হয় ভিন্ন খেলা। এই ভিন্ন খেলার নেতৃত্ব দেন বেলালের বান্ধবী মাহফুজা। মিয়ানমারের চক্রটি ফোন করে টাকা আদায়ের চেষ্টা শুরু করে। আর এসব টাকা আদায়ের জন্য ব্যবহার করা হয় আবদুল্লাহর বাংলাদেশের একটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট নম্বরসমূহ। যার কাজে সহযোগিতা করেন আয়াছ। আবদুল্লাহ সাবরাং এলাকার পরিচয় দিলেও তার বোন, মা, বাবা, ভাই মিয়ানমারের থাকেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টেকনাফে বসেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্টের নামে হুন্ডি ব্যবসা করেন আবদুল্লাহ। তিনি হুন্ডির মাধ্যমে চক্রের কাছে টাকা পাঠান।

মিজানুর রহমান বলেন, এ সংঘবদ্ধ চক্রটি বিশাল। অনেকের নাম পাওয়া গেছে। তাদের ধরতে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়েছে। কোন থানায় কারা নিখোঁজ আছে, এ বিষয়ের জিডির তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। কতজন নিখোঁজ রয়েছে তার তথ্য জিডির তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে।

পাঠকের মতামত: